মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলির মধ্যে বিশিষ্ট চরিত্র হল কুবের। যাকে কেন্দ্র করেই এই উপন্যাস। আজকে আমরা এই উপন্যাসর প্রধান চরিত্র কুবের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কুবের চরিত্র
ভূমিকা : কুবেরই পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র, উপন্যাসের নায়ক। পদ্মার ধারে কেতুপুর গ্রামের জেলেপাড়ার অধিবাসী । মাছ ধরা আর নৌকায় মাঝিগিরি করাই তার জীবিকা । কুবেরকে আমরা প্রথম দেখি বর্ষার মাঝামাঝি পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুমে । সারারাত ধরে অনির্বাণ জোনাকির মত শত শত আলো জ্বেলে শত শত নৌকায় জেলেরা সারারাত ধরে মাছ ধরে । রাত্রে শ্রান্ত মানুষ যখন চোখ বুজিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তখন এরা সব শ্রান্তিকে জয় করে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকে ।
কুবের মাছ ধরে কিন্তু ওর নিজস্ব কোন জাল এবং নৌকা নেই । সেজন্য ওকে ভাগে অন্যের নৌকা এবং জাল নিয়ে মাছ ধরতে হয় । প্রতি রাতে যত মাছ ধরা হয় তার অর্ধেক ভাগ ধনঞ্জয়ের , বাকি অর্ধেক কুবের ও গণেশের । নৌকা এবং জালের মালিক বলে ধনঞ্জয়ের পরিশ্রম কম । সে কেবল নৌকার হাল ধরে বসে থাকে । আর
“ একহাত এক খানি কাপড়কে নেংটির মতো কোমরে জড়াইয়া ক্রমাগত জলে ভিজিয়া ,শীতল জলোবাতাসে শীত বোধ করিয়া , বিনিদ্র আরক্ত চোখে লণ্ঠনের মৃদু আলোয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চাহিয়া থাকিয়া কুবের ও গণেশ সমস্ত রাত মাছ ধরে । ”
জালে প্রচুর মাছ পড়লেও কুবেরের ভাগ্যের বিশেষ পরিবর্তন হয় না । বেশী মাছ ধরা পড়লে বাজারে মাছের দর কমে যায় । নিজের জাল নৌকা না থাকায় তাকে সবসময় দু আনা চার অন্যে ভাগে মজুরি খাটতে হয় । যা কিছু উপার্জন তা এই ইলিশের মরশুমে । সেজন্য শরীর থাক আর যাক , এ সময়টা একটা রাত্রিও কুবেরের ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয় । অসুস্থ শরীরেও কুবেরকে মাছ ধরতে আসতে হয় । মাঝে মাঝে তামাক খেয়ে একটু সতেজ হওয়ার চেষ্টা করে । সারারাত মাছ ধরে সকাল সকাল এসে সবাই হাজির হয় ঘাটে । এখান থেকেই চালানবাবু মাছ গুণে সব বরফ দেওয়া প্যাকিং কেস ভর্তি করে কলকাতায় চালান দেয় । এখানে চালান বাবুকে শতকরা পাঁচটা করে চাদা দিতে হয় । তারপর ধনঞ্জয়ও হিসেবের কারচুপি করে কুবেরদের ঠকায় । কুবের সব জানে এবং বোঝে । তাই সে নিজেও মাঝে মাঝে মাছ সরিয়ে অন্যের কাছে সত্তা দরে বিক্রি করে দেয় । এত কঠোর পরিশ্রমের পর এভাবে প্রতি পদে পদে বঞ্চনা আর প্রতারণায় ক্ষোভে দুঃখে কুবেরের চোখে জল আসে ।
“ গরিবের মধ্যে সে গরিব , ছোটলোকের মধ্যে আরও বেশী ছোটলোক । এমনভাবে তাহাকে বঞ্চিত করিবার অধিকারটা সকলে তাই প্রথার মতো , সামাজিক ও ধর্মসম্পর্কীয় দশটা নিয়মের মতো , অসংকোচে গ্রহণ করিয়াছে সে । প্রতিবাদ করিতেও পারিবে না । মনে মনে সকলেই যাহা জানে মুখ ফুটিয়া তাহা বলিবার অধিকার তাহার নাই । ”
সারা রাত পরিশ্রমের পর কয়েক আঁজলা নদীর জল পান করেই তাকে কাটাতে হোল । কুবেরের সঙ্গে সংগতি রেখেই যেন জেলেপাড়ার চরম দারিদ্র্য , অবহেলা আর বঞ্চনা । এ জগতে স্থানের অভাব না থাকলেও জেলেপাড়ার আছে এক নির্মম সীমাবদ্ধতা । গায়ে গায়ে ঘর বেঁধে এরা কোনক্রমে টিকে থাকে । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র শ্লেষের সঙ্গে লিখেছেন,
“ জেলেপাড়ায় ঘরে ঘরে শিশুর ক্রন্দন কোন দিন বন্ধ হয় না । ক্ষুধা তৃষ্ণার দেবতা , হাসি কান্নার দেবতা , অন্ধকার আত্মার দেবতা , ইহাদের পূজা কোন দিন সাঙ্গ হয় না । ”
গ্রামের ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণেতর ভদ্র মানুষেরা এদের দূরে ঠেলে রাখে । প্রকৃতি এদের বিরুদ্ধে । ঝড় , জল , শীতের হাড় কনকনে ঠান্ডা এদের কাবু করে । টিকে থাকার নির্মম প্রয়োজনে এরা নিজেদের মধ্যে রেষারেষি , কাড়াকাড়ি করে কোনমতে বেঁচে থাকে । এখানে ঈশ্বরও থাকেন না । তিনি থাকেন ওই গ্রামে , ভদ্রপল্লীতে । এরকম জেলে সমাজের কুবের একজন সার্থক প্রতিনিধি । ফলে কুবের এই উপন্যাসে একজন ব্যক্তি হয়েও সমষ্টির একজন । ব্যক্তিকে দিয়ে ওদের জেলে সমাজের পরিচয় ।
কুবেরের পিসী তার ঘরদোর , তার সংসারে ঢেঁকি , পঙ্গু অথচ ফর্সা স্ত্রী মালা । সে ঘরের মধ্যে বন্দী । আর তার সন্তানের জননী । দারিদ্র্য যার নিত্যসঙ্গী তার কাছে রাজপুত্তুরের মত নতুন সন্তানের আগমনেও কোন আনন্দ বার্তা বহন করে আনে না । বরং বিরক্ত হয়ে কুবের বলে ,
“ পোলা দিয়া করুম কী ? নিজেগোর যাওন জোটে না , পোলা ? ”
এই গরীব মানুষদের জীবনেও এক একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে । এরাও দূরের রথের মেলায় যায় । টুকি টাকি জিনিস কেনে অন্যের ফেলনা জিনিস কুড়িয়ে আনে , বালা খেলার নামে জুয়াও খেলে । কুবেরের অবশ্য এসব কোন দোষ নেই । বরং কুবেরের আছে এক সংবেদনশীল মন । গণেশের নিজের জ্যাঠা হীরু মিথ্যা অজুহাতে গণেশকে একটু চাল কর্জ দিল না । কুবের তখন রেগে গিয়ে বলে –
“ আমার ঘরে পাঠালি না ক্যান বৌরে ? ”
গরিব হলেও সে ‘ দুর্গা চাল কর্জ দিতে পারে । তিন বছর পরে ময়নাদ্বীপ থেকে যখন রাসু পালিয়ে এল তখন কুবেরই নদীবক্ষে বহুদূরের হাঁক শুনে বলেছিল ঐ হাঁক “ আমাদের রাসুর ” র । রহস্যময় হোসেন মিয়া রাসুদের ময়নাদ্বীপে নিয়ে গিয়েছিল । এখন রাসু ফিরে এসে হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আনবে । গ্রামের মানুষের কাছে হোসেন মিয়ার মত এক মানী লোকের মাথা নত হবে এই চিন্তায় কুবের উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল এত বড় একটা কঠিন কর্মঠ শক্তিশালী একগুঁয়ে সম্মানকামী লোকের অপমান হবে একথা ভাবতেই কুবের হোসেন মিয়ার প্রতি মমতা বোধ করে । সম্ভব হলে সে হোসেন মিয়ার পক্ষ নিত । এই সংবেদনশীল মনের জন্যই হয়ত তার কপিলার প্রতিও সমবেদনা জাগে ।
দুরন্ত মেয়ে কপিলার বিয়ের পরে একটি মেয়ে হয়ে আঁতুড়েই মারা গেছে । তারপর থেকে সে স্বামী বিতাড়িত । তার স্বামী রাগ করে আরেকটা বিয়ে করেছে । বাধ্য হয়ে কপিলা বাপের বাড়ি চলে এসেছে । তাঁর মা তাকে পোড়াকপালী এবং অলক্ষ্মী বলে সবসময় গালমন্দ করে । স্বামী ত্যাগ করলেও কপিলার কাঁচা বয়স । কুবেরের সঙ্গে কেতুপুরে এসে তার মহা আনন্দ । কপিলা কুবেরের শ্যালিকা । কুবেরের স্ত্রী মালা পঙ্গু । তার মুখে হাসি নেই , জীবন তাকে অলস করে বিষণ্ণ করেছে । কুবের গরিব । বাড়িতে অতিথি এলেও খুব চিন্তার বিষয় কিন্তু কপিলার আগমনে মালা কুবের সকলেরই জীবনে যেন একটা খুশির হাওয়া বয়েছিল । যে কুবের তার স্ত্রী মালাকে নিয়ে সুখের সংসার করছিল কপিলা আসার পরে মালার মধ্যে চলিষ্ণুতা , প্রাণোচ্ছ্বলতা হাসি – রহস্যের যে অভাব ছিল কুবের কপিলার মধ্যে সে সব পেয়ে দারিদ্র্যের মধ্যেও জীবনের একটা পূর্ণতা অনুভব করেছিল । হোসেন মিয়ার মতো কপিলাকেও তার মনে হয়েছিল বড় রহস্যময় ও দুর্বোধ্য । কপিলাও কুবেরের বাড়িতে থাকতেই বেশি পছন্দ করে । ‘ বেগুনী রঙের শাড়িখানি পরিয়া চুলে চপচপে তেল দিয়া শুধু লীলাখেলা করিতেই কপিলা পটু নয় , কুবেরের সেবাও সে করে , —জীবনে কুবের কখনো যে সেবার পরিচয় পায় নাই । ”
স্বাভাবিকভাবেই কপিলার প্রতি তার একটা আকর্ষণ বাড়ে । কপিলা থাকলে তার জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যেও যেন একফালি বাতাস আসে ।
“ আর কিছু চায় না কুবের কপিলার কাছে , গোপনে শুধু সুখ – দুঃখের কথা বলিবে । একটু রহস্য করিবে কপিলার সঙ্গে , বাঁশের কঞ্চির মত অবাধ্য ভঙ্গিতে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া কপিলা টিটকারি দিবে তাকে , ধরিয়া নোয়াইয়া দিতে গেলে বসিয়া পড়িবে কাদায় । চাপা হাসিতে নির্জন নদীতীরে তুলিয়া দেবে রোমাঞ্চ । “
আমরা তাই দারিদ্র্য্যে জর্জরিত , পরিবেশ পরিজন দ্বারা বঞ্চিত অথচ কঠোর পরিশ্রমী এই কুবের মাঝিকে জীবনে একমাত্র সহজ হতে দেখি কপিলার সঙ্গে । ” তার মত গরিব কে আছে জগতে ? ” কিন্তু গরিব হলেও সে তো মানুষ । তার জীবনেও আনন্দ আহ্লাদ আছে , সুখ দুঃখের অনুভূতি আছে । কুবেরের মধ্যেও যে একটা গভীর জীবনবোধ আছে কপিলার সান্নিধ্যে আছে তারই প্রকাশ । কপিলাই প্রথমে কুবেরের সেই অন্তরসত্তাকে জাগিয়ে তুলেছে ।
কুবেরের স্ত্রী মালা পঙ্গু বলে তার কোন আপশোশ ছিল না । কিন্তু কপিলা যখন তাকে নদীতীরে তামাক এনে দেয় , কুবেরের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে কুবেরের অপেক্ষায় নদীতীরে কপিলা দাঁড়িয়ে থাকে , সারারাত পদ্মার বুকে কাটিয়ে যখন কুবের বাড়ি ফিরে আসে তখন না চাইতেই পা ধোয়ার জল পায় , পান্তাভাতের কাঁসিটি সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে ,
“ খাইয়া উঠিবামাত্র তামাক আসে প্রস্তুত থাকে তাহার দীনমলিন শয্যা এবং ফাঁক পাইলেই কোন দিন গোঁফ ধরিয়া টান দিয়া , কোনদিন একটি চিমটি কাটিয়া , হাসি চাপিয়া চোখের পলকে উধাও হইয়া — ঘুম আসিবার আগেই কপিলা তাহাকে স্বপ্নও আনিয়া দেয় । ”
এমনি করে কপিলার সঙ্গে কুবেরের জীবন ও স্বপ্ন জড়িয়ে যায় । আশ্বিনের প্রবল ঝড়ে কুবেরের শোবার ঘরখানা পড়ে গিয়ে তার মেয়ে গোপীর ডান পায়ে খুব চোট লেগেছে । সেই বিপদের দিনে কপিলা প্রাণ দিয়ে সকলের সেবা করেছে । সেজন্য কুবের কপিলার কাছে কৃতজ্ঞ । গোপীর পায়ের যন্ত্রণা বেড়ে যাওয়ায় তাকে আমিনবাড়ির হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় । সেই বিপদের সময়ও কপিলা সঙ্গী হয়েছিল । এমনকি গোপীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েও কপিলা বাড়ি ফিরে গেল না । গোপীকে আর একবার না দেখে সে ফিরে যেতে পারে না । কুবেরের ছেলেমেয়ের জন্যও তার অনেক দরদ এবং চিন্তা । স্ত্রীলোক হয়েও সে কীভাবে কুবেরের সঙ্গে থাকবে এ নিয়ে কুবেরের গভীর চিন্তা থাকলেও কপিলার কোন দুশ্চিন্তা নেই । সে শুধু গোপীর জন্য দুশ্চিন্তায় কাঁদে ।
পরদিন সকালে গোপীকে আবার হাসপাতালে দেখে তারা বাড়ি ফিরেছিল । রায়ে কপিলার সঙ্গে আমিনবাড়িতে কাটাতে হয়েছিল কোন সুনাম দুর্নামের ভয়ই করে না । বলে কুবেরের মনে স্বাভাবিক কুন্ঠা এবং শঙ্কা দেখা দিয়েছিল কিন্তু কপিলা নির্বিকার । সে যেন কপিলার স্বামী শ্যামাদাস যখন তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পরে কপিলাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল গিয়েছে । অভাব বেড়েছে । তখন কুবেরের সংসার যেন ফাঁকা হয়ে গেল । কপিলার সঙ্গে যেন তার ঘরের লক্ষ্মী চলে ততদিনে বর্ষার মরশুম শেষ । শীত এসে পড়েছে । বাধ্য হয়ে সে হোসেন মিয়ার নৌকায় মাঝিগিরির কাজ নেয় ।
যদিও সে ভালভাবে জানে হোসেন মিয়ার উপকার গ্রহণ করলে শেষ পর্যন্ত তার মঙ্গল হবে না , তবু জীবিকার প্রয়োজনে এ ছাড়া তার উপায় ছিল না । হোসেন মিয়ার নৌকায় কাজ করে কুবেরের আর্থিক কিছুটা স্বচ্ছলতা এসেছে । মাঝিগিরির অভিজ্ঞতা বেড়েছে । ময়নাদ্বীপ এবং হোসেন মিয়া সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়েছে । মৎস্যজীবী এবং পদ্মানদীর মাঝি কুবের নদীকে বড় ভালবাসে । নদীর বুকে ভেসে চলার মত সুখ আর নেই । সমুদ্রে নৌকায় পাড়ি দিবার সময় তার পদ্মানদীর কথা বড় মনে পড়ে । সমুদ্রের কোন কুল কিনারা নেই । তবে নদীর মতো প্রবল জলস্রোত আছে । নদীর কাউয়াচিলা পাখি , মৎস্যশিকারী বক , চির যৌবনা পদ্মা , মাঝির জীবনেও এক অদ্ভুত আবেগের সৃষ্টি করে । এই মাঝিদের জীবনে কোন জাতিভেদ নেই । হোসেন মিয়ার মায়নাদ্বীপেও কোন মন্দির মসজিদ নেই ।
হোসেন মিয়ার সম্পর্কে আমরা দেখেছি , প্রথম থেকেই কুবেরের একটা আতঙ্ক বা ভয় আছে । কারণ হোসেন মিয়ার সব রহস্যাবৃত । স্পষ্ট করে তার সম্পর্কে কিছু জানা যায় না । ময়নাদ্বীপে এসে কুবেরের সেই ভুল ভাঙল । হোসেন মিয়ার ক্ষমতা এবং মনের জোর দেখে সে বিস্মিত হয়ে গেল । ময়নাদ্বীপ সম্পর্কে কুবেরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সব ভুল ভেঙে গেল । কুবের প্রত্যক্ষ করে এক নির্জন দ্বীপে জনপদ বসানোর স্বপ্ন হোসেন মিয়াকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় । ময়নাদ্বীপের নেশা না পেয়ে বসলে হোসেন মিয়া , তো স্বচ্ছন্দে একজন বড়লোক হতে পারত । তার এই স্বপ্নকে বাস্তবে সম্ভব করে তোলবার জন্যই হোসেন মিয়া যেভাবে সম্ভব আর্থোপার্জন করে । কুবের লক্ষ্য করে লোকটার অদ্ভুত প্রতিভা এবং মনের জোর । যেখানে যত ভাঙাচোরা মানুষ পায় কুড়িয়ে নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সে নিজের রাজ্য স্থাপন করছে ।
এই জনপদের সকলকেই হোসেন নানাভাবে কত উপকার করে । আশ্বিনের ঝড়ে আমিনুন্দির স্ত্রী মারা যাবার পরে হোসেনের চেষ্টাতেই আমিনুদ্দির নছিবনের মত স্ত্রী জুটেছে । রসুলকে হয়ত জেলের ঘানিই টানতে হোত । হোসেন কারো উপর কোন জোর – জবরদস্তি করে না । কুবেরের সপ্তানবাৎসল্য এবং হিসেবিবুদ্ধিও উল্লেখ করবার মতো । আশ্বিনের ঝড়ে ঘর পড়ে গিয়ে তার মেয়ে গোপীর পা ভেঙে যাওয়াতে কুবেরের দুশ্চিন্তা বেড়েছে । মেয়ের পা ঠিক না হলে তার বিয়ের ব্যাপারে নানা জটিলতা । ময়নাদ্বীপ ফেরৎ রাসু গোপীকে বিয়ে করতে চায় । তার স্ত্রী মালা তাতে সম্মত হলেও কুবেরের আশা আরও বড় । সে রামুর কাছেও দেড় কুড়ি টাকা পণ আর দুকুড়ি টাকার গহনা দাবী করে । রাসুর সে সামর্থ্য নেই । কুবেরের পছন্দ ছিল তার সহ মাঝি গণেশের শ্যালক যুগল । নিজের চেষ্টায় সে তার অবস্থা ভাল করেছে । কিন্তু হঠাৎ ঝড়ে গোপীর পা ভেঙে যাওয়ায় সে আশা নষ্ট হয়ে গেল । গোপীর পায়ের চিকিৎসায় রাসু অনেক সাহায্য করেছে । গোপীর পা টা একটু সেরে আসতেই রাসু বিয়ের জন্য চাপ দিল । কিন্তু কুবের রাসুকে হাতে রাখে । বলে , গোপীর পা যদি না সারে তাহলে তাকে রাসুর সঙ্গে বিয়ে দেবে আর যদি সেরে যায় তাহলে কুবের আরও যোগ্য পাত্র আশা করে ।
শেষ পর্যন্ত হোসেন মিয়াই গোপীর জন্য পাত্র ঠিক করে দেয় । তার নাম বন্ধু , বয়স বেশী নয় । বন্ধু পাঁচকুড়ি টাকা পণ দিবে কুবেরকে , গোপীকে গহনা দিবে তিনকুড়ি টাকার আর একদিন জেলেপাড়ার সকলকে দিবে ভোজ । শেষ পর্যন্ত এই বিবাহই হয়ে গেল আর কুবেরের জীবনে ঘটে গেল বিপর্যয় । রাসুর মামা পীতম মাঝির চুরি যাওয়া ঘটিটা পাওয়া গিয়েছে । কুবেরের ঢেঁকিঘরের পাটখড়ির বোঝার তলে । বাড়ি ফিরলেই চৌকিদার কুবেরকে ধরে জেলে পাঠাবে । কুবের বুঝতে পারে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে রাসুই এ চক্রান্ত করেছে । এখন আর তার কিছু করবার নেই । বাধ্য হয়ে নদীর ঘাট থেকেই কুবের ময়নাদ্বীপে চলে গেল ।
“ স্ত্রী – পুত্রের জন্য ভাবনা নাই কুবেরের ; হোসেন রহিল । পরে গোপী আর বন্ধুর সঙ্গে ওদের সকলকে হোসেন ময়নাদ্বীপে পৌঁছাইয়া দিবে । ”
এক প্রকার নিশ্চিত মনেই কুবের ময়নাদ্বীপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল । তখনো তার সঙ্গী ছিল কপিলা । কপিলা কুবেরের সঙ্গে ময়নাদ্বীপে যেতে চাইলে কুবের তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল । কপিলাকে সঙ্গে নিয়ে ময়নাদ্বীপে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেও স্ত্রীপুত্র কন্যার প্রতি তার দায়িত্বের অভাব ছিল না । তার স্ত্রী মালা পঙ্গু হলেও মালা সম্পর্কেও তার কোন অভিযোগ ছিল না । কপিলা সেই বন্যার সময় থেকে কুবেরের সঙ্গে কেতুপুরে চলে আসার পর অনেকদিন কুবেরের বাড়ি ছিল । কপিলার আচরণ এবং চলাফেরা সম্পর্কে মালার কোন অভিযোগ বা আপত্তি ছিল না । অনেক সমালোচক কুবের কপিলা সম্পর্কে যে অবৈধ যৌন গন্ধের ইঙ্গিত করেন উপন্যাসে কোথায়ও তার সন্ধান পাওয়া যায় না । যদি এরকম কোন অভিসন্ধি থাকত তাহলে নারী এবং স্ত্রী হিসেবে মালার তা অগোচরে থাকবার কথা নয় । স্ত্রী মালাকে নিয়ে কুবেরের দাম্পত্য জীবন ভালোই কেটে যাচ্ছিল । বন্যার সময় কুবের যখন চরডাঙ্গায় গেল তখন মালার মা কুবেরের প্রশংসা করে বলেছিল ,
” সোনার জামাই তুমি , খোঁড়া মাইয়ারে আমার মাথায় কইরা থুইছ । ”
জেলেপাড়ার পুরুষেরা সাধারণত হৃদয়হীন , তাৎক্ষণিক পাওনা ছাড়া তারা আর কিছুই বোঝে না । কুবেরও তার ব্যতিক্রম নয় তবু মালার মায়ের কথা শুনে কুবের বিস্মিত হয় । তবে একথা সত্য ,
“ পঙ্গু বলিয়া মালাকে সে কখনো অনাদর করে নাই । ”
“ মালার জন্য , তাহার দারিদ্র্যপূর্ণ সংসারের ওই অলস অকর্মণ্য রমণীটির জন্য , কুবের হঠাৎ নিবিড় স্নেহ অনুভব করে ; সৎ গৃহস্থ ও সৎ স্বামী বলিয়া যে প্রশংসা তাহার মালার জননী গলার জোরে দিগদিগন্ত রটনা করে তাহা যেন মালারই কীর্তি । ”
মালার নামে মেজোকত্তাকে নিয়ে যে কথা রটে তা কুবের জানে । সে এসব গায়ে মাখে না । সে জানে মালা পঙ্গু হলেও ওর মতো গায়ের চমড়ার নারী জেলেপাড়ায় খুঁজে মেলা ভার । পঙ্গু না হলে সে কুবেরের ঘরে পায়ের ধূলা ঝাড়তেও আসত না পঙ্গু বলে কুবের মালাকে কখনো অনাদর করে নি । শুধু একবার গোপীর ভাঙা পা ঠিক হওয়ায় মালাও রাসু এবং মেজোকত্তার সঙ্গে আমিনবাড়ি হাসপাতালে পা দেখাতে গিয়েছিল বলে নয় , মেজোকত্তার সঙ্গে গিয়েছিল বলেই কুবের রাগের চোটে মালাকে প্রহার করেছিল কিন্তু পরক্ষণেই তার চেতনা ফিরে এসেছিল ।
শেষকথা : এই উপন্যাসে আমরা দেখি , কুবের গরীব হলেও একজন সংবেদনশীল মানুষ , পদ্মানদীর মাঝিদের একজন হয়েও ব্যতিক্রমী মানুষ । সেজন্যই তাকে নায়ক করে এই উপন্যাস লিখিত হয়েছে ।