বীরাঙ্গনা কাব্যের নারী চরিত্রগুলি কোন অর্থে বীরঙ্গনা,বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণ

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নায়িকারা কোন অর্থে ‘বীরাঙ্গনা’ আলোচনা করো।

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নারী চরিত্র গুলো আলোচনা করো।

বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা।

তোমরা যদি বীরাঙ্গনা কাব্যের নারীচরিত্র কতটা বীরাঙ্গনা হয়ে উঠতে পেরেছে মুধুসূদনের এই কাব্যে নিয়ে বাংলা নোট খুঁটেছেন তাহলে এই লেখাটি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে যাবে।

আমি কিশোর রায়, বাংলা নিয়ে আমি M.A শেষ করেছি (Bengali Honours)। এখনোও বাংলা নিয়ে পড়াশুনা করে যাচ্ছি। আজকে মধুসূদন এর লেখা বীরাঙ্গনা কাব্যের নারী চরিত্রগুলি নিয়ে আজকে তোমাদের জন্য এই নোটটি তুলে ধরলাম।

“নামকে যারা নামমাত্র মনে করেন আমি তাদের দলে নেই”

—- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রাক কথা :

ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে নাম সবসময় আইডেন্টির প্রকাশ নাও হতে পারে কিন্তু শিল্প সাহিত্য ক্ষেত্রে অবশ্যই নামের দ্বারা রচিত বিষয়ের অভিযোগটি ধরা যায় আন্তাজ করা যায়, অভিপ্রায় ও পরিকল্পনাটি।

সুতরাং শুধুমাত্র চিত্রিতকরন অলংকারের জন্য নাম শিল্প-সাহিত্যে এ কথা খাটে না। নাম করেন নানান ধরনের হয়ে থাকে যেমন – কখনো ব্যক্তি কেন্দ্রিক নাম, কখনো ঘটনা কেন্দ্রিক নাম, কখনো বা ভাবাত্মক নাম। সকল ধরনের নামের এই একটা পৃথক গুরুত্ব আছে এবং সে গুরুত্ব বুঝতে হলে বিষয়বস্তুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

আজকে আমরা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নারী চরিত্রগুলি কোন অর্থে বীরাঙ্গনা এবং মধুসূদন এর লেখা বীরাঙ্গনা কাব্যটির নাম করণের সার্থকতা সম্পর্কে আজকের এই আলোচনা।

বীরাঙ্গনা কাব্য: প্রসঙ্গ নামকরণ

 বীরাঙ্গনা কাব্যের প্রতিটি পত্র পাঠ করে আমরা একথা দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি যে, মধুকবি মধুসূদন বীরাঙ্গনার শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ মনে রেখে বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণ করেননি। এই কাব্যের কোন নায়িকারা অস্ত্র হাতে রণক্ষেত্রে অবর্তীর্ণ হয়নি, তবুও যে মাইকেল তাদের বীরঙ্গনা বলে অভিহিত করেছেন ; তাতে তিনি রেনেসাঁসের সন্তান।

তিনি জানতেন যথার্থ বীরত্ব অস্ত্র নৈপুণ্যের নয় মনন নৈপুণ্যে। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন সমাজ নারীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সবদিক থেকে। নারী নিজে কথা ভাবতে ভুলে গেছে। আত্মমর্যাদাবোধও নারীদের বিলুপ্তপ্রায়, অন্ধ সংস্কারে জগদ্দলে চাপা পড়ে গেছে তাদের সমস্ত মানবিক আকাঙ্ক্ষা।

নারী বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতে রিজিয়ার মতো, চিত্রাঙ্গদা প্রমীলার মতো চরিত্র সৃষ্টি করে তিনি বারবার প্রকাশ করেছেন বিমুক্ত নারীর আদর্শ।

‘বীরাঙ্গনা’ সেই আদর্শলিপি চিত্রশিল্প স্থাপনা। এ কাব্যে নায়িকারা প্রত্যেক যুক্তিশীলতা স্বাধীন। যুক্তি তাদের সাহস এবং তাদের আত্মমর্যাদাবোধ এবং কর্তব্য কর্তব্য নিয়ন্ত্রণ।

 বস্তুত ভাবগত যুক্তিশীলতা বীর্যেই তারা ‘বীরাঙ্গনা’।

বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা:

অতঃপর আমরা বীরাঙ্গনা কাব্যের কয়েকটি পত্র অবলম্বনে বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণ এর যথার্থ অনুসন্ধান করতে পারি –

বীরাঙ্গনা কাব্যের শকুন্তলা কোন অর্থে বীরাঙ্গনা :

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের প্রথম পত্র “দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা” এই পত্রিকায় আমরা শকুন্তলাকে স্বামীর সোহাগিনী রুপে পাই। কিন্তু তিনি পত্র লিখেছেন নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার, এই অধিকার প্রতিষ্ঠার করার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে শকুন্তলার ব্যক্তিত্ব তার স্বামীর প্রতি অভিমান অভিযোগের মধ্যে ফুটে উঠেছে নারীর প্রতিবাদ –

শুনেছি রথি শ্রেষ্ঠ তুমি,

 বিখ্যাত ভারত ক্ষেত্রে ভীমবাহুবলে;

 কী যশ: লাভিলা, কহ, যশস্বী, বিনাশী –

 অবলা-কুলের বালা আমি-মুখ মম! “

—- পত্র “দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা”

 শকুন্তলা নিজেকে বারবার দুষ্মন্তের দাসি বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু সেকালের অসংখ্য বাঙালি নারীর মতো নারী ব্যক্তিত্বর নামে দাসীত্ব অপমানকর গ্লানিতে লাঞ্চিত করেননি। বরং সেখানে তার স্বতন্ত্র রূপটি ফুটে উঠেছে।

 কেননা শকুন্তলা দুষ্মন্তের দুষ্মন্তের স্ত্রী, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অধিকার চিরকালের। শকুন্তলা সেই অধিকার চাওয়ার নারী চরিত্র। তাই তাকে আমরা বলতে দেখেছি –

কিছু নাই লোভে দাসি বৈভব। সেবিবে_

 দাসি ভাবে পা’দুখানি -এই লোক মনে,

 এই চির আশা, নাথ, এ পোড়া হৃদয়ে।

—- পত্র “দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা”

বীরাঙ্গনা কাব্যের বীরঙ্গনা ‘তারা’ :

 বীরঙ্গনা দ্বিতীয়পত্রটি “সোমের প্রতি তারা“, এই পত্রিকায় কলঙ্কিনী তারা যে, প্রেম সোমের প্রতি নিবেদন করেছে তার সামাজিক দিক থেকে যত কলঙ্কিনী হোক না কেন সেখানে নারীর আত্মসত্ত্বা প্রকাশের বাসনাকে আমরা কখনো অস্বীকার করতে পারিনা।

স্ত্রীর-প্রতি-স্বামীর-কর্তব্য তা চিরকালের, কিন্তু জ্ঞান তপস্বী বৃহস্পতি তারা’কে স্ত্রী হিসেবে যথার্থ মূল্য না দিয়ে নারী হৃদয়ের যে কামনা, বাসনা সেই চিরন্তন সত্তাকে অস্বীকার করে ; আশ্রমের শীর্ষ জ্ঞানী শাস্ত্র চর্চায় মনোনিবেশ করেন। নবজাগ্রত যৌবন যে কলঙ্কের শাসন মানতে পারেনা তার একটি বারও ঋষির কল্পনা জাগেনি।

 তাই প্রেম বঞ্চিত তারা তা শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে পারেনি এবং সেই কারণেই তারার মনে কামনা-বাসনা দ্বিধাহীনভাবে অন্য পুরুষ কে অবলম্বন করে প্রকাশিত হয়েছে –

 ” এস তবে প্রাণ সথে,  দিনু জলাঞ্জলি

 কাল মনে তব জন্যে – ধর্ম লজ্জা ভয়ে।

 কুলের পিঞ্জর ভাঙ্গি, কুল বিহঙ্গিনী,

 উড়িল পবন পথে ধর আমি তরে তারানাথ।

— পত্র “সোমের প্রতি তারা

মোটকথা নায়িকা তারা, সোমের প্রতি যে প্রেম নিবেদন করেছে তাতে করে মধুসূদন দেখাতে চেয়েছেন সামাজিক অনুশাসন এর বিরুদ্ধে নারী দ্বিধাহীন প্রতিবাদকে। তারা এখানেই তারা বীরঙ্গনা।

বীরাঙ্গনা কাব্যের বীরাঙ্গণা কৈকেয়ী :

 বীরাঙ্গনা কাব্যের চতুর্থ পত্র “দশরথের প্রতি কৈকেয়ী”। এই পত্রটি অনুযোগ পত্রিকার মধ্যে অন্যতম উৎকৃষ্ট পত্রিকা। ভজ্ঞ রাজা দশরথ প্রতি কৈকেয়ী মুক্ত কণ্ঠের বলেছে –

অসত্যবাদী রঘুকুল প্রতি!

নির্লজ্জ! প্রতিজ্ঞা তিনি ভাজ্ঞেন সহজে

ধর্ম্ম-শব্দ মুখে গতি অধর্ম্মের পথে।

—- পত্র “দশরথের প্রতি কৈকেয়ী”

কৈকেয়ীর সংযমের বাধ ভেঙেছে। প্রতি হিংসা কামনায় তাকে বলতে দেখেছি আমরা –

থাকে যদি ধর্ম্ম তুমি অবশ্য ভুঞ্জীবে

এ কর্মের প্রতিকলা।

—- পত্র “দশরথের প্রতি কৈকেয়ী”

দাসত্বহীন মুক্ত মানসিকতা তাকে যথার্থই বীরাঙ্গনায় পরিণত করেছে।

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বীরাঙ্গনা দ্রৌপদী :

‘বীরাঙ্গনা কাব্যের’র ষষ্ট পত্র – “অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী”। পঞ্চ পান্ডবের স্ত্রী হলেন দ্রৌপদী। পঞ্চস্বামীর ভালোবাসা পেয়েও তার ঋদয় তৃপ্ত হতে পারেনি। সুপুরুষ সব স্বামীদের পেয়েও, তার ঋদয়ের আকাঙ্খা ছিল তৃতীয় পান্ডব অর্জুনকে একমাত্র স্বামী হিসাবে পাওয়ার। অর্জুনকেই তিনি মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। সমাজের চোখে এটা অন্যায় কারণ, পঞ্চস্বামীকেই পতি হিসাবে বরণ করেছেন।

কিন্তু মধুসূদনের দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর স্ত্রী হিসাবে নিজেকে ভাবতে লজ্জাবোধ করেন। তাই তিনি উচ্চারণ করেছেন –

ধনঞ্জয়! এই জানি, এই খানি মনে।

মা ইচ্ছা করুন ধর্ম্ম, পাপ করি যদি,

ভালোবাসি মৃমনিরে মা ইচ্ছা, মৃমনি।

হেন সুখ ভুঞ্জি, দুঃখ কে ডরে ভুঞ্জিতে?

পত্র – “অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী”

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বীরাঙ্গনা জনা :

বীরাঙ্গনা কাব্যের এগারত্তমপত্র (11পত্র ) ‘ “নীলধ্বজের প্রতি জনা” এই পত্রিকায় কবি মধুসূদন জনার নারী সুলভ কোমল ঋদয়াত্তার সঙ্গে নারীর বীরাঙ্গ রূপকে অপূর্বভাবে মিশেয়ে দিয়েছেন।

পুত্রের মৃত্যুতে জনার বিলাপ সাধারণ পুত্রশোকাতুর নারীর বিলাপ অশ্রু নেই, আছে শুধু অগ্নিময় জ্বালা।

আমাদের মনে হয়, জনা পুত্র শোকের চেয়ে স্বামীর আচরণে বেশি পীড়িত। কেননা, স্ত্রী হিসাবে জনা স্বামীর কাছে যথার্থ মূল্য পায়নি। রাজা নীলধ্বজ জনার প্রতি কোনো সহমর্মিতা পোষণ করেননি। এই কারণে অবহেলিত, যোগ্য অধিকার থেকে বঞ্চিতা জনা বিক্ষুব্ধ চিত্তে স্বামীর কাছে প্রতিবাদ জানায় –

ক্ষেত্র-কুল বালা আমি, ক্ষেত্র-কুল বধূ ;

কেমনে এ অপমান সব ধর্য্যে ধরি?”

— পত্র ‘ “নীলধ্বজের প্রতি জনা”

জনা স্বামী নীলধ্বজকে বলেছেন যে, পুত্র হত্যার সঙ্গে তার এই আচরণ অলোভন। এই জনা দৃপ্ত তেজে লিখেছে হস্তীনাপুরের সমারোহ শেষ করে যখন স্বামী নীলধ্বজ রাজপুরীতে ফিরে আসবেন, তখন দেখেন রাজপুরি শুন্য –

ফিরি যবে রাজপুরে প্রবেশিবে আসি,

নরেশ্বর, “কোথা জনা”? বলি ডাক যদি,

উত্তরিবে প্রতিধ্বনি “কোথা জনা”? বলি।

— পত্র ‘ “নীলধ্বজের প্রতি জনা”

জন আর পুত্রের মধ্যেই আমরা যথার্থ বীররসের সন্ধান পেয়েছি প্রকৃত বীর নারী জনা, জনা যথার্থই বীরাঙ্গনা।

শেষ কথা :

 উপরোক্ত আলোচনার সূত্র ধরে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নায়িকারা কোনো আন্তরিকতা বীরঙ্গনা নয় বরং বলা চলে আপন আপন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব প্রকাশে এরা সকলেই বীর নারী সাহসী পদক্ষেপে, মানসিক বীর্যে তারা বীরাঙ্গনা হয়ে উঠেছে। ভাবগত ব্যঞ্জনাময় অর্থকে মনে রেখেই মধুসূদন তার বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণ করেছেন বলে আমরা মনে করি।

‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের নারী চরিত্রগুলি নিজ নিজ অর্থে যথার্থই বীরঙ্গনা হয়ে উঠতে পেরেছে।

  • যে কোনো বাংলা নোট এর জন্য হোয়াটস্যাপ করতে পারো : 9800692181

By admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *