পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের মালা চরিত্র | এই উপন্যাসে কুবের মাঝির স্ত্রী মালা । কালাকুন্ঠি কুবেরের ঘরে ‘ গোরাচাদ ’ ‘ রাজপুত্তুরের ‘ জননী’ মালা । মানিক বন্ধোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে অন্যতম চরিত্র হলো মালা । আজকে আমরা এই মালা চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ।
পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের মালা চরিত্র
জেলে পাড়ার মধ্যে মালার গায়ের রং গৌরবর্ণ । তা নিয়ে জেলে পাড়ায় কানাকানির অভাব নেই । বিশেষ করে গ্রামজীবনে বৈচিত্র্য বলতে তো পরনিন্দা আর পরচর্চা । তাই কালো মানুষের ফর্সা ছেলে হলেই চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে । তা ছাড়া গ্রামের মেজোবাবুর সঙ্গে জড়িয়ে মালার সম্পর্কে একটা কুৎসা দিয়েই উপন্যাসের শুরু । গরিব কুবেরের ঘরে বাসের আযোগ্য , অস্বাস্থ্যকর এক ভিজা স্যাঁতসেতে বিছানায় নবজাত শিশুকে নিয়ে মালার দিনরাত কাটে । তবু মালার মুখে কুবেরের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই ।
অবশ্য জেলেপাড়ার মেয়েদের নিজস্ব কোন মতামতের মূল্যও কম । সন্তানের জন্যই তাদের প্রয়োজন । কুবেরও মালাকে তাই বলে । অন্যান্য ব্যাপারে মেয়েদের মতামতের মূল্য মালার রঙ কালো নয় , বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতই ওকে ফরসা দেখায় । জেলেপাড়ার কোন স্ত্রীলোকের গায়ে এমন চামড়া নেই । কুবের নিজেই জানে একটা পা যদি ওর হাঁটুর কাছে
“ দুমড়াইয়া বাঁকিয়া না যাইত , কুবেরের ঘরে ও পায়ের ধূলা ঝাড়িতেও আসিত না । ” পঙ্গু বলে বাইরের জগতের সঙ্গে মালার পরিচয় কম । “
ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকেই সে ছেলেদের মারামারিকে বড় ভয় করে , নিজের ছেলে দুটিকেও সে ঘরে আটকে রাখতে চায় । কিন্তু ছেলেরা কী কথা শোনে । সুযোগ পেলেই তারা বাইরে চলে যায় । তবু প্রত্যেকদিন নানা ছলে সে তাদের কাছে রাখবার চেষ্টা করে । সেজন্য সন্তান – স্নেহের হিসাবে জেলেপাড়ার জননীদের মধ্যে মালার মৌলিকতা আছে । ছেলের বয়স আট দশ বছর পার হয়ে গেলে তার সম্পর্কে আর জেলেপাড়ার মেয়েরা চিন্তা করে না । তারা নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে । দুটি কুঁড়েঘরের কুটীরে সংকীর্ণ সংসার হলেও তাদের অফুরন্ত কাজ । পুরুষেরা মাছ ধরে আনে , পাইকারী কেনা – বেচাও করে কিন্তু চুপড়ি মাথায় করে বাড়ি বাড়ি মাছ যোগান দেওয়া মেয়েদের কাজ । সপ্তান প্রসবের আগে পিছে দু – একটা মাস ছাড়া এ কাজটা সারা বছরই মেয়েদের করতে হয় ।
” অপোগণ্ড শিশু ছাড়া আর কোন সন্তানের ছোট ছোট বিপদ – আপদের কথা ভাবিবারও যেমন তাহাদের সময় নাই , ওদের স্নেহ করিবার মত মানসিক কোমলতাও নাই । নবজাত সন্তানকে তাহারা যেমন পাশবিক তীব্রতার সঙ্গে মমতা করে , বয়স্ক সন্তানের জন্য তাহাদের তেমনি আসে অসভ্য উদাসীনতা । ছেলে মরিয়া গেলেও শোক তাহারা করে না , শুধু সুর করিয়া মড়াকান্না কাঁদে । ”
সেজন্য কচি ছেলে ছাড়া মায়ের কোলে কোন সন্তান থাকে না । তাদের স্বামীরাও হয় নিষ্ঠুর । মালা পঙ্গু তাই অলস । ঘরের কোনায় সে স্বতন্ত্র জীবন যাপন করে । জেলেপাড়ার রূঢ় বাস্তবতা তাকে স্পর্শ করে নি । তাই সে তার ছেলেমেয়েগুলোকে ভালবাসে । সারাদিন পরে পাখির ছানার মত তার ছেলেমেয়েরা যখন ঘরে ফিরে আসে তখন তারা ভদ্র ও বাধ্য ছেলের মত মায়ের কাছে ঘেঁষে আসে ।
“ মালার কাছে বসিয়া তাহারা ভাত খায় । এক ছেলের মুখে স্তন গুঁজিয়া রাখিয়া আর দুজনকে ভাত মাখিয়া গ্রাস মুখে তুলিয়া খাওয়ানোর মন মালার একার নয় , এমনিভাবে খাওয়াইয়া না দিলে ওরা খাইতে চায় না । “
তাছাড়া মালা রূপকথা বলে । এদিক থেকে মালা জেলেপাড়ার এক ব্যতিক্রমী চরিত্র । মালার মাথায় উকুন , গায়ে মাটি , পরণে ছেঁড়া দুর্গন্ধ কাপড় কিন্তু যখন সে রূপকথা বলে তখন সে যেন এক নিখুঁত ভদ্রমহিলা । এই রূপকথা বলার পরিবেশটিও চমৎকার ।
“ ডিবরির শিখাটি ঊর্ধ্বর্গ ধোঁয়ার ফোয়ারা , মাথার উপরে চাল পচা শনের , চারিপাশের দেয়ালে চেরা বাঁশের স্যাঁতসেতে ঢেউতোলা মাটির মেঝে । ”
এই পরিবেশে রূপকথা বলাকে মানিক লিখেছেন ,
“ আদিম অসভ্যতার আবেষ্টনী । অভিনয় সুমার্জিত সভ্যতার । “
কুবেরও এক এক সময় এসে মন দিয়ে মালার রূপকথা শোনে । বড়লোকের বাড়ির পোষা কুকুরের মত স্নেহ মমতার এই সব কান্ড কারখানা সে উদাস চোখে চেয়ে দেখে । মালা তন্ময় হয়ে রূপকথা বলে । তার রূপকথা শোনার আগ্রহ কেবল তার ছেলেমেয়েদের নয় । কুবের , তার পিসি এবং পাড়ার আরো সব বৌ এবং ছেলে – মেয়েদের । আসে গণেশের বৌ উলুপী , ছেলে মনাই ,আর মেয়ে কুকী । সিধুর তোতলা হাবা মেয়ে বগলীও আসে । রূপকথা বলার সময় মালা পাড়ার মেয়েদের শালীনতার দিকেও লক্ষ্য রাখে । তখন মালাকে সত্যি আর জেলেপাড়ার বৌ বলে মনে হয় না । মালা খুব সংবেদনশীল নারী । তার স্নেহ মমতা ভালোবাসার কথা আগেই বলা হয়েছে ।
ভীষণ বর্ষায় তার বাপের বাড়ি যখন এক কোমর জলের নীচে তলিয়ে গিয়েছিল , তখন তার খবর শুনে মালা কেঁসে অস্থির হয়েছিল । কুবেরকে তাদের খবর আনতে পাঠিয়েছিল । কুবের সেখান থেকে মালার ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে কেতুপুরে এসেছিল । তাদের দেখে পঙ্গু এবং বিষণ্ণ মালার মুখে হাসি ফুটেছিল । কুবেরের মত গরিব মানুষের সংসারে এতগুলো নতুন অতিথি এসে পড়লে কুবের চিন্তিত হয় কিন্তু মালা খুব খুশি হয়েছে । হাসি ফুটেছে মালার মুখে । কুবের বরং তা দেখে ক্ষুব্ধ হয় । কারণ সে স্বামীর দুঃখ না বুঝে বাপ – ভাইয়ের জন্য কেঁদে মরে । এই সময়ই মালার স্বামী পরিত্যক্তা বোন কপিলাও এসেছিল । কপিলা আসার পর থেকে কুবের খুব খুশি হয়েছে ।
কিন্তু এ নিয়ে মালা কোনদিন কোন অভিযোগ করে নি । গোপীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে কুবের – কপিলা একরাত আমিনবাড়িকাটিয়ে এল । এ নিয়েও মালা কাউকে কোন প্রশ্ন করে নি । খোঁড়া মালাকে নিয়ে কুবের সংসার পেতেছে , অসুখী কুবের নয় , দারিদ্র্যের পীড়নে সে কষ্ট পায় বটে কিন্তু পারিবারিক জীবনটি তার কামনা করবার মত । এর জন্য মালার অবদানও কম নয় । মালার জীবনে একটাই দুঃখ । সে পঙ্গু । তাই সে যখন দেখল তার মেয়ে গোপীর পা অপারেশন করে হাসপাতালে ঠিক করে দিয়েছে তখন তারও ইচ্ছে হোল তার পাটাও যদি হাসপাতালে ঠিক করে দেয় । এটাই তার জীবনের একমাত্র সাধ । কুবের কিন্তু তেমন গা করে না । বলে ,
‘‘ তর পায়ের কিছু হইব না গোপীর মা । ”
দুঃখে মালার চোখে জল আসে । সে বুঝতে পারে তার জন্য কুবেরের কোন দরদ নেই । মেয়ে গোপীর জন্য সে দশবার হাসপাতাল যাতায়াত করতে পারে কিন্তু একবারের জন্যও তার জন্য পারে না । এই একবারই মালা কুবেরকে কপিলার কথা বলে । কপিলার মত ভঙ্গি করে হাঁটতে পারে না বলেই মালার প্রতি কুবেরের যত অবজ্ঞা ।
অবশেষে কুবের মালাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে রাজী হয় । কিন্তু তার সময় হয় না । অবশেষে একদিন গোপীও রাসুর সঙ্গে মেজবাবুর নৌকায় আমিনবাড়ির হাসপাতালে মালা গিয়েছিল । কিন্তু ডাক্তার বলেছে তার এই পঙ্গুত্ব ঘুচবার নয় । সেদিন এ ব্যাপারে মালা এবং কুবেরের মধ্যে দারুণ কলহ হয়ে গেল । মালা এবং মেজবাবুকে কেন্দ্র করে নানা রটনা প্রচলিত ছিল । কুবের সে সব কোন দিন ভ্রুক্ষেপ করে নি । কিন্তু এবার দিনের পর দিন মাঝিগিরি করে এসে কুবেরের মেজাজ ঠিক ছিল না । মালার সঙ্গে কুবেরের দারুণ কলহ হয়ে গেল । গোঁয়ার সহজ কুবের । আমিনবাড়ি যাওয়ার জন্য অম্লানবদনে সে মালাকে পীড়ন করে । তার মনে হয়েছিল মালা হয়ত প্রতিশোধ নিয়েছে । একদিন সে কপিলার সঙ্গে আমিনবাড়িতে রাত কাটিয়ে এসেছিল , সেজন্য মালাও হয় ত একই উপলক্ষের ছল করে মেজবাবুর সঙ্গে আমিনবাড়ি গিয়েছে । মালা বাড়ি ফিরে গোঁয়ার কুবেরের রাগ ভাঙাবার জন্য অনেক চেষ্টা করে । পরে মালাও রেগে গিয়ে বলল ,
“ ক্যান মাঝি ক্যান , এত গোসা ক্যান ? কবে কই নিছিলা আমারে , চিরডাকাল ঘরের মধ্যি থাইকা আইলাম , এউককা দিনের লাইগা বেড়াইবার যাই যদি , গোসা করবা ক্যান ? ”
সেদিন কুবের মালার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছিল তার জন্য পরে নিজেই অনুতপ্ত হয়েছিল । মালা জানে কুবের কঠোর নির্মম । সহজে তার রাগ কমে না । কিন্তু গোঁয়ার হলেও এই সহজ মানুষের রাগ দীর্ঘস্থায়ী হয় না । মেজবাবুর সঙ্গে যাওয়ার কথা শুনেই কুবের রেগে আগুন হয়েছিল । কিন্তু অন্য বিষয়ে মালার সঙ্গে তার ব্যবহার বদলায় না , পঙ্গু অসহায় স্ত্রীর জীবন তারই বক্ষের আশ্রয়ে সবসময় উথলে ওঠে ।
“ আজ রাত্রেই হয়তো কুবের মালাকে বুকে জড়াইয়া মিঠা মিঠা কথা বলিবে , পদ্মার ঠান্ডা বাতাসে জুড়াইয়া জুড়াইয়া কি যে মধুর হইয়া উঠিবে কুবেরের ব্যবহার । কাল হয়তো আবার সে কাঁদাইবে মালাকে মেজবাবুর কথা তুলিয়া । এমনি প্রকৃতি পদ্মানদীর মাঝির , ভদ্রলোকের মত একটানা সংকীর্ণতা নয় , বিরাট বিস্তারিত সংমিশ্রণ । ”
অতএব ভদ্রলোকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এদের বিচার সার্থক হতে পারে না । মালার আরেকটি সত্তা জননী সত্তা । সে তার ছেলেমেয়েদের যেমন সব সময় আঁকড়ে রাখতে চায় তেমনি গোপীর বিয়ের ব্যাপারে তার উদ্বেগ লক্ষণীয় । কুবেরের প্যাঁচ বা মনের কথা সে বোঝে না তাই হাতের কাছে পাওয়া রাসুর সঙ্গেই সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য চঞ্চল হয়ে জ্বেলে সমাজে নারীর মতামতের কোন মূল্য নেই । তাই গোপীর বিবাহের ব্যাপারে কুবেরের সিদ্ধান্তই শেষ কথা । তা সত্ত্বেও কুবেরের স্ত্রী হিসেবে মালার যেমন কোন অভিযোগ নেই , তেমনি কুবেরেরও মালার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই । সেজন্য মানিক লিখেছেন গরিব হলেও এদের জীবন কামনা করবার মতো । শরীর তার পঙ্গু হলেও মন মালার পঙ্গু নয় । কুবের – কপিলার ঘনিষ্ঠতার মধ্যেও সে দোষণীয় কিছু মনে করে নি সেজন্য মালা শুধু জেলে সমাজেরই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র নয় , নারী হিসেবেও তার অনন্যতা অনস্বীকার্য ।
[…] পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের মালা চরিত্র […]